মহীতোষ মণ্ডল
A Bengali piece on the new horizons in poetry by Mahitosh Mandal| First Published in Asamapika, Volume 2, August 2019 | Published as blog post on 19 January 2023 | wwww.mahitoshmandal.com
একটা কথা প্রায়ই শোনা যায় । বাঙালি মাত্রই নাকি কবিতা লেখে । এটা অত্যন্ত বাজে কথা । সারা পৃথিবীতে লোকজন কাব্য চর্চা করে । যাইহোক, ডায়েরী খুললে অনেক বাঙালিরই দুয়েকটা অভিমান, দুঃখ বা প্রতিবাদ পদ্য বা ছড়ার আকারে পাওয়া যেতেই পারে। সে স্কুলের প্রথম ক্রাশের জন্যই হোক বা কলেজে হোক কলরব করে হোক বা বড় বয়সে বিশ্বনিন্দুক হওয়ার পরেই হোক । আজকাল ফেসবুকে তো হরদম কবিতা পোস্টাচ্ছে লোকজন । আবার লিটল ম্যাগাজিনে কবিতা পাঠানো থেকে শুরু করে বড় পত্রিকায় কবিতা ছাপিয়ে বিখ্যাত হয়ে যাওয়া, বা কবিতা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার গল্প প্রচুর আছে । কান পাতলেই শোনা যায় ।
এখন প্রশ্ন, সব কবিতা কি কবিতা হয়ে ওঠে? এক মহান কবি বলেছেন, সবাই কবি নয় । কেউ কেউ কবি । আমার মনে হয় সব কবিতাই কবিতা নয় । কিছু কিছু কবিতা কবিতা । এই ফর্মুলা ওই “কেউ কেউ কবি”দের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য । রবি ঠাকুর নামজাদা কবি । অনেক অসাধারণ কবিতা লিখে গেছেন । তবে রবীন্দ্র রচনাবলী ঘাঁটলে এরম অনেক কবিতাই পাওয়া যাবে যেগুলোকে মোটেই অসাধারণ বলা যায়না । ছন্দ মিলিয়ে দুয়েকটা উপমা দিলাম কি না দিলাম আর তাই দিয়ে পাতা তিনেক গল্প লিখে গেলাম আর তা কবিতা হয়ে গেলো এরম থোড়াই হয় । একথা তথাকথিত প্রায় সব বড় কবির ক্ষেত্রেই সত্যি – দেশীয় হোক বা ভিনদেশী। অনেকটা ক্রিকেটের মত । বিরাট কোপালি বিরাট ফায়ারপ্লেস । খুব প্রেসিডেন্ট রান করেন । কিন্তু তা বলে ভুললে চলবে না যে তিনি কিছু কিছু ম্যাচে রীতিমত ঝোলান । অর্থাৎ, বড় বড় কবিরা বেশী সংখ্যক ভালো কবিতা লেখেন । তবে তারা কিছু কিছু ঝুল কবিতাও লেখেন অনেক ক্ষেত্রে । তাদের কবিতাসমগ্র পড়লে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে ।
আমার কাছে তাই বিবেচ্য এই নয় যে কে বড় কবি । আমার প্রশ্ন ভালো কবিতা বলতে কি বোঝায় ? যে কবিতা গুলোকে অসাধারণ কবিতা বলি, সেগুলো কোন ভিত্তিতে অসাধারণ? মাপকাঠি আছে কিছু? আমার মনে হয়, অসাধারণ কবিতা সেটাই যেটা নতুন ধরনের । তার ভাষা নতুন । তার ভাবনা নতুন । এই নূতনত্ব লুকিয়ে থাকে কবির স্বতন্ত্র উচ্চারণে শুধু নয় । অনেক ক্ষেত্রে তার উৎপত্তি কবির স্বতন্ত্র অভিজ্ঞতায় । এই প্রসঙ্গে আমি তিনটি কাব্য ধারার উল্লেখ করব – শেক্সপিয়ারের সনেট, হলোকস্টের কবিতা আর দলিত সাহিত্য । এই তিনটি ধারা তিন ভাবে এই নূতনত্বের ব্যাপারটা ফুটিয়ে তোলে ।
প্রথমটি দিয়ে শুরু করা যাক । ইউরোপে সনেট লেখার অন্যতম স্রষ্টা ছিলেন পেত্রার্ক । ইটালিয়ান এই কবি লরা নামক এক নারীকে নিয়ে কত সনেট লিখলেন । আর তাতে করলেন তার প্রেমের উদযাপনযাপন আর প্রেয়সীর সৌন্দর্যের উচ্চ প্রশংসা। পেত্রার্ক যখন নবজাগরণের কবিদের একের পর এক প্রভাবিত করছেন তখনি শেক্সপিয়ার সেই পেত্রার্কান ট্র্যাডিশন ভেঙ্গে দিলেন । কিভাবে ভাঙলেন? তিনি সনেটের গঠনপ্রনালী যথা লাইন আরেঞ্জমেন্ট পাল্টে দিলেন । তার সঙ্গে বিষয়বস্তুর দিক থেকে উদযাপন যাপন করলেন দু ধরনের প্রেম । এক, তিনি প্রেম নিবেদন করলেন এক সাদা চামড়ার তরুণ কে – যে প্রেমকে অনেকে মনে করেন আধ্যাত্মিক । দুই, তিনি প্রেম নিবেদন করলেন এক কালো চামড়ার নারীকে – যে প্রেম পুরোপুরি যৌন । ফেয়ার ইয়ুথ আর ডার্ক লেডির এরম অনুবাদ হয়তো একটু সংকীর্ণ হয়ে গেল । তা হোক । মূল বক্তব্য হলো, প্রেমের সংজ্ঞাটাই পুরো বদলে দিলেন শেক্সপিয়ার । প্রেম মানেই নারী পুরুষের সম্পর্ক নয় – সমলিঙ্গের সম্পর্ক অথবা সমকামীতাও সনেটের বিষয় হতে পারে । আর প্রেম যদি নারী পুরুষের সম্পর্কও হয়, তাহলেও সেখানে নারীকে তথাকথিত ফরসা আর রূপসী হতে হবে এরম রক্ষণশীল ধারণাতে আঘাত হানলেন কবি । এই সাবভারশনই সনেটে আনলো নতুন দিগন্ত । শেক্সপিয়ার হয়ে গেলেন “মহান” কবি ।
এবার একটা বিশাল লাফ দিয়ে বিংশশতাব্দীতে আসি । বিখ্যাত ইহুদী তাত্ত্বিক থিয়োডর অ্যাডোরনো বলেছিলেন হলোকস্টের উপর কবিতা লেখা বর্বর সুলভ । তাঁর মতে, হলোকস্টের অভিজ্ঞতা কোন অর্থেই কাব্যিক হতে পারেনা । লক্ষ লক্ষ ইহুদীদের রাতের অন্ধকারে পাচার করে দেওয়া হতো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে যেখানে তাদেরকে পায়রার খোপের মত ছোট ছোট খুপরিতে গাদাগাদি করে থাকতে হতো। আর তাদেরকে জল বা খাবার না দিয়ে বা নোংরা খাবার খাইয়ে রেখে যতক্ষণ শক্তি আছে ততক্ষণ খাটিয়ে নেওয়া হতো । এসবের মধ্যে ক্লান্ত হয়ে গেলে গুলি খেয়ে বা গ্যাস চেম্বারে পুড়ে মরার যে ভীতি এবং যন্ত্রনা, আর যারা তা-থেকে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছে তাদের যে আজীবনের ট্রমা, তা নিয়ে আর যাই হোক কবিতা লেখা যায়না ।
তবে অ্যাডোরনোর মন্তব্যে হলোকস্ট নিয়ে কবিতা লেখা পুরোপুরি অসম্ভব এরমটা কিন্তু বলা হয়নি । তিনি যেটা বলতে চেয়েছেন বলে মনে হয়, তা হলো কবিতা বলতে যা বোঝা হত হলোকস্টের আগে পর্যন্ত সেই কাব্যচেতনা এই অভিজ্ঞতাকে ধরতে পারবেনা । যে কবিতা মানবতার জয়গান করে বা সৌন্দর্যের উপসনা করা, সেই কবিতার সঙ্গে হলোকস্টের কোন যোগ থাকতে পারেনা । অর্থাৎ যদি হলোকস্ট নিয়ে কবিতা লিখতেই হয় তাহলে সেই কবিতা হতে হবে সম্পূর্ণ নতুন ধারার । সম্ভবত এতোটাই নতুন যে তাকে কবিতা বলে চিনতে পারা যাবেনা । বস্তুতঃ, পরবর্তীতে অ্যাডোরনো এরমই একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন নিজের বিতর্কিত মন্তব্যের ।
হলোকস্টের অন্যতম প্রধান কবি পূর্বতন রোমানিয়ার অধিবাসী পল চেলান । ইহুদি হওয়ার জেরে চেলানের বাবা আর মাকে নাৎসিরা জোর করে ধরে নিয়ে পুরে দেয় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে । সেখানে তার কর্মক্লান্ত মাকে গুলি করে মেরে ফেলে হিটলারের অনুগামীরা । আর বাবা ক্যাম্পেই মারা যান টাইফুস নামক জ্বরে আক্রান্ত হয়ে। চেলানকে নিজেকেও থাকতে হয়েছিলো কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে । সেখানে চোখের সামনে তিনি দেখেছেন তার সঙ্গীদের কিভাবে অত্যাচার করেছে নাৎসি বাহিনী । যখন গ্যাস চেম্বারে পাঠানোর জন্যে লাইনে তাকে দাঁড় করানো হয় তখন সেখান থেকে নজর এড়িয়ে পালিয়ে যান তিনি । বেঁচে যান মৃত্যুর মুখ থেকে । তবে সেই পুড়ে মরার ভয়, মা-বাবাকে হারানোর বেদনা, সঙ্গীদের চোখের সামনে মরতে দেখা আর সর্বোপরি ক্যম্পের ভয়াবহ পরিবেশ সারাজীবনের জন্যে ট্রমাটাইজড করে দেয় চেলানকে । বিশ্বযুদ্ধ এগোনোর সাথে সাথে নাৎসিদের পরাজয় এবং কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলো মুক্ত করার কারণে চেলান আবার স্বাভাবিক পৃথিবীতে ফিরে আসেন । তবে সেই দুঃস্বপ্নময় স্মৃতি তাকে এগোতে দেয় না । ফ্রান্সে চলে যান তিনি । লেখালেখি করেন । তবে অবশেষে সেইন নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন ।
এই যে বীভৎসতা, যা চোখের সামনে দেখলেন চেলান, সেটা নিয়ে কী কবিতা লেখা যায়? তবু চেলান লিখলেন । প্রথম দিকের কবিতায় চেলান বললেন কন্সেন্ট্রেশন ক্যাম্পের প্রেক্ষিতে কেনো মৃত্যু জীবনের থেকে হাজার গুণ শ্রেয় । পরের দিকের কবিতায়, এই বিষয়ের পাশাপাশি, হলোকস্ট নিয়ে যে কবিতা লেখা অসম্ভব – সেই অসম্ভবতাও ফুটিয়ে তুললেন কবি । শব্দগুলো যেন গলা থেকে বেরতে পারেনা, এমনি যন্ত্রনা বিদ্ধ ক্যাম্পের মৃতপ্রায় ইহুদী । কবিতাতে এই যন্ত্রণার ছাপ পড়ল । শব্দ সংখ্যা কমে গেলো । আর যে শব্দগুলি থাকলো সেগুলোর আন্তঃসম্পর্ক হয়ে গেলো দুর্বোধ্য । শুধু কিছু অস্ফুট স্বর । গ্যাস চেম্বারে আগুনে পুড়ে যেতে যেতে অসংলগ্ন হয়ে যা রয়ে গেলো বাতাসে । তাই রূপ পেলো কবিতার । অনেকে বলেন, চেলান আর অ্যাডোরনোর সম্পর্ক তিক্ত ছিলো । হলোকস্ট নিয়ে কবিতা লেখা বর্বর সুলভ, এই মন্তব্য নাকি চেলানকে উদ্দেশ্য করে করা হয়েছিলো । আর এই মন্তব্যই নাকি চেলানের পরের দিকের কবিতাকে প্রভাবিত করেছিলো । জীবনের জয়গান না গেয়ে হাজার হাজার ইহুদিদের স্বেচ্ছামৃত্যু কামনা করতে বাধ্য করে যখন কিছু অমানুষ সে ঘটনার সাক্ষী থাকা এক অভূতপূর্ব অমানবিক অভিজ্ঞতা । আর সেই বিষয়ে কবিতা লেখার অসম্ভবতা নিয়ে যে কবিতা, সেই কবিতা এক নতুন ধারার কবিতা । সেই জন্যই ইউরোপের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কবিদের মধ্যে চেলান একটি অন্যতম নাম ।
হলোকস্ট যেমন খুলে দিয়েছে কাব্যের নতুন দিগন্তের । তেমনি দলিত সাহিত্য উন্মোচন করেছে স্বতন্ত্র এক কাব্য ধারার । অনেকে প্রশ্ন তোলেন – দলিত সাহিত্য কি আদৌ সাহিত্য? নাকি তা আসলে রাজনীতি ? মারাঠী লেখক করন কুমার লম্বালম্বি মত অনেক দলিত করালে এসবের আলোচনা তাত্ত্বিক করেও গেছেন । জাতপাত আর ব্রাম্ভন্ন্যবাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ক্রোধ প্রকাশ করে চলেন দলিত সাহিত্যিকেরা । তাই তাদের লেখাতে – সে কবিতা, গল্প, উপন্যাস বা আত্মজীবনীই হোক – তথাকথিত সুন্দরের উপাসনার বদলে রয়েছে সামাজিক অবমাননার ইতিহাস আর অমানবিকতার প্রতিচ্ছবি । দলিত সাহিত্যিক মাত্রই জানেন যে সুন্দরের উপাসনা আর মানবতার জয়গান তাদের সাহিত্যের বিষয়বস্তু হওয়া মুশকিল। কারণ তাদের ব্যক্তি-অভিজ্ঞতায় এসবের প্রায় কোন জায়গাই নেই । দলিত কবিতা তাই এতোটাই নতুন একটি ধারা যে তাকে তথাকথিত ভাবে কবিতা বলা মুশকিল হয়ে যায় – আবার, কেবল মাত্র রাজনীতি বলেও উপেক্ষা করা যায়না । তামিল দলিত কবি মীনা কান্ডাস্বামির কথা ধরা যাক । তার এক ইংরেজিতে লেখা কবিতার নাম ‘দিস পোয়েম উইল প্রভোক ইউ’। প্রায় ইস্তাহারের মত এই কবিতা জানান দেয় যে দলিত কবিতা হিন্দু ধর্মের তুলোধনা করার কবিতা । তা উচ্চ বর্ণের মানুষদের রাগিয়ে দেওয়ার জন্যই লেখা । আর সেজন্যে হয়তো মেইনস্ট্রিমে দলিত কবিতা রেকগনিশন পাবেনা । তবুও দলিত সাহিত্য ক্ষমা চাইবে না । অনবরত উচ্চারণ করে যাবে হিন্দু সমাজ জাত ব্যবস্থার নামে কিভাবে দাস ব্যবস্থা চালিয়ে যাচ্ছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ।
এই যে তিনটি ধারার কথা বললাম, এগুলো হয়তো একটু আলটপকা হয়ে গেলো । ইচ্ছে করেই এরমটা করলাম । এর অর্থ, নূতনত্ব অনেক ভাবেই আসে বা আনা যায় কবিতায় । তার কোন একটা পথ হতে পারেনা । এই নূতনত্ব হয়তো প্রথম বার লিখতে গিয়ে নাও আসতে পারে । তবে নূতনত্ব আসছে কিনা সেটা একজন কবির বোধ হয় খেয়াল রাখা জরুরি । যে কবিতা নতুন দিগন্ত খোঁজে সেই কবিতা ইতিহাস সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখে । অনেক ক্ষেত্রে এরম একটা দুটো কবিতাই কাফি কবিকে বিশ্ব সাহিত্যে স্থান করে দেওয়ার জন্যে । তাই, শুধু সৃজনশীল হলেই বোধ হয় হয়না । একজন গবেষকের মতই কি কবিকে নব দিগন্তের সন্ধানে পাড়ি দিতে হয় ?